মুসলমানদের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় জমায়েত ‘তুরাগ পাড়ের বিশ্ব ইজতেমা।’ পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে তাবলিগ জামাতের লোকেরা ছুটে আসেন এখানে।
এখান থেকে দীক্ষা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে। নিজেদের ইমান-আমল-আখলাক সুন্দর করার পাশাপাশি অপরাপর মুসলিমদের জীবন গঠন ও সুন্দরের চিন্তা নিয়ে ঘুরে বেড়ান দেশে-বিদেশে। ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরও দাওয়াত দেন তারা।
কথাবার্তা, খাবার-দাবার, চালচলনসহ সব কিছুতেই অতি সাধারণ থাকার চেষ্টা করেন এ দলের লোকেরা। লক্ষ্য থাকে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শে জীবন রাঙানো। কোরআন-সুন্নাহের পথ আঁকড়ে থাকা।
এই আদর্শ জামাতটি এমনিতেই গঠিত হয়নি, এর পেছনে রয়েছে তিক্ত প্রেক্ষাপট ও করুণ ইতিহাস। সময়টি ছিল বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের (১৯১০-১৯২০)। উপমহাদেশে তখন চলছিল ব্রিটিশ শাসন। ইংরেজরা প্রায় দু’শ বছর (১৭৫৭-১৯৪৭) জগদ্দল পাথরের মতো এ অঞ্চলের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে থেকে সীমাহীন নির্যাতন করেছিল জনগণের ওপর।
বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ে ওপর। প্রায় আটশ বছরের ইসলামি ঐতিহ্য, শিক্ষা-দীক্ষা, তাহজিব-তমদ্দুনের মূলে কুঠারাঘাত করেছিল তারা। এদেশে মুসলিমদের ধর্মীয় তৎপরতা বন্ধের জন্য যা করার দরকার ছিল, সবই করেছিল তারা।
গৌরবোজ্জ্বল মুঘল আমলে প্রতিষ্ঠিত হাজার হাজার মসজিদ-মাদ্রাসার ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ইসলামের মূল কেন্দ্রগুলো সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছিল। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয় যে, মৃতদের কাফন-দাফনের মতো কোনো যোগ্য লোক খুঁজে পাওয়া যেত না! নামাজ, রোজা, আজান-ইকামতের অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ! তখন মদিনাওয়ালার ইশারায় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দে হজরত কাসেম নানুতুবি (রহ.) গোড়াপত্তন করেন দারুল উলুম দেওবন্দের।
যার আদলে ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় মাদ্রাসা তৈরি হয়ে মুসলমানদের শিশু-কিশোরদের কিছু কিছু দ্বীন শিক্ষার ব্যবস্থা করলেও বয়স্কদের দ্বীন-ধর্ম চর্চার কোনো মহল ছিল না। বিশেষ করে জীবন-জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত গরিব চাষা-মজুরদের জন্য ধর্মকর্ম পালনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মানুষ কালেমা জানত না।
অজু-গোসল চিনত না। নামাজ-রোজা থেকে ছিল বহু দূরে। নামেমাত্র মুসলমান হলেও কাজ-কামে ছিল ধর্মীয় বৃত্তের বাইরে। অধিকাংশ ছিল অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। মুসলমানদের এমন ধর্মীয় দুর্দশা ভাবিয়ে তুলে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-কে।
সাধারণ মানুষের দ্বীন শিক্ষা ও চর্চার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নিজ এলাকা ভারতের রাজস্থানের মেওয়াতে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে হতদরিদ্র, দিনমজুর, কৃষক-চাষিদের নিয়ে তাবলিগ জামাতের সূচনা করেন। অতঃপর ১৯২০ সালে দিল্লিতে এর কর্মতৎপরতার বিস্তৃতি ঘটে।
পঞ্চাশের দশকে মাওলানা আবদুল আজিজ (রহ.)-এর প্রচেষ্টায় ঢাকা ও এর আশপাশে তাবলিগের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে এটি ভারত উপমহাদেশের গ-ি পেরিয়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাবলিগ জামাতের সূচনাকালে এর নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)।
১৯৪৪ সালে তার ইন্তেকালের পর এর হাল ধরেন তারই ছেলে মাওলানা ইউসুফ (রহ.)। শায়খুল হাদিস মাওলানা যাকারিয়া (রহ.) তাবলিগি লোকদের পাঠ্য হিসেবে বহু পুস্তক রচনা করেন। মাওলানা ইউসুফ ও শায়খুল হাদিস যাকারিয়া (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তখন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের নেতৃত্ব দেন মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.)।
বাংলাদেশে তাবলিগের কাজ শুরুর পর কয়েক স্থানে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সাল থেকে টঙ্গীর তুরাগ পাড়ে বিশ^ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তখন থেকে অদ্যাবধি এখানে নিয়মিতভাবে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। পাকিস্তানের রায়বেন্ড ও ভারতের ভূপালেও বড়সড় ইজতেমা হয়। কিন্তু তা বাংলাদেশের ইজতেমার মতো বিশাল নয়। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় দেড়শ’র মতো দেশ বিশ^ ইজতেমায় অংগ্রহণ করে। দুই পর্বের ইজতেমায় প্রায় পঞ্চাশ লাখ লোকের সমাগম হয়।