স্তব্ধ আর্জেন্টিনা

আর্জেন্টিনা কয় গোল করবে, এর মধ্যে লিওনেল মেসিরই বা কয়টি থাকবে—সৌদি আরবের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ম্যাচের আগে আলোচনা ছিল এ রকমই। কিন্তু বাস্তবতা কি আর সব সময় কল্পনার সঙ্গে মেলে! এ ম্যাচেও মিলল না।




বিশ্বের বেশির ভাগ ফুটবলপ্রেমী বা অনুসারী মেসির শেষের শুরুর এ ম্যাচের যে পাণ্ডুলিপি লিখে রেখেছিলেন, দৃশ্যায়নটা সেভাবে হলো কই! ফুটবল–দেবতা যে চিরকালই খেয়ালি! আবারও নিজস্ব খেয়ালে মেসির শেষের শুরুর গল্প লিখলেন হতাশার রঙে। বিশ্বকাপের অন্যতম অঘটনের জন্ম দিয়ে তাই আর্জেন্টিনাকে ২–১ গোলে হারিয়ে দিল সৌদি আরব।

তাহলে ওই যে ম্যাচের আগে ফুটবলপ্রেমীরা যে আর্জেন্টিনা ও মেসির গোলের হিসেব করল, সেগুলো সব কোথায় গেল! পিট সিগারের গানের কলির সঙ্গে মিলিয়েই বলতে পারেন—অফসাইডের বাঁশি সব কেড়ে নিল! হ্যাঁ, নাটকীয় প্রথমার্ধে সৌদি আরবের জালে তো ৪ বারই বল পাঠিয়েছিল আর্জেন্টিনা। এর মধ্যে ১০ মিনিটে পেনাল্টি থেকে করা মেসির গোলটিই টিকে রইল, বাকি ৩টি আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের জন্য পাতা সৌদি আরবের অফসাইডের ফাঁদে আটকে গেছে।




পেনাল্টি থেকে মেসি যে গোলটি করেছেন, তার পটভূমির শুরু ম্যাচের ৮ মিনিটে। বক্সের বাইরে থেকে মেসি ফ্রি–কিক নিয়েছিলেন। সেট থেকে বক্সের বাইরে বল পেয়ে শট নেন লাওতারো মার্তিনেজ। তিনি শট নেওয়ার সময় বক্সের ভেতরে ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে যান রদ্রিগো দি পল। এটি ফাউল ছিল কি না, পরীক্ষা করতে ভিএআরের সাহায্য নেন স্লোভেনিয়ার রেফারি স্লাভকো ভিনচিচ। ফিরে এসে পেনাল্টির নির্দেশ দেন তিনি। অসাধারণ শটে বল জালে পাঠিয়ে বিশ্বকাপে মার্তিন পালের্মোর পর আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় বয়োজেষ্ঠ্য গোলদাতা হয়ে যান মেসি।

এরপরই অফসাইডের কারণে গোল বাতিলের অবিশ্বাস্য সেই স্পেল। প্রথমটি ২১ মিনিটে বল জালে পাঠান মেসি। কিন্তু তিনি উদ্‌যাপন শুরু করার আগেই রেফারি পেনাল্টির বাঁশি বাজান। ৭ মিনিট পর আবার একই ঘটনা। এবার বল জালে পাঠান লাওতারো মাতিনেজ। দি পলের দারুণ পাস ধরে এগিয়ে আসা গোলকিপারের ওপর দিয়ে বল জালে পাঠান। রেফারি গোলের বাঁশি বাজান, মার্তিনেজ উদ্‌যাপন করেন। কিন্তু সৌদি আরবের খেলোয়াড়েরা প্রতিবাদ করলে রেফারি ভিএআরের সাহায্য চান। ফিরে এসে দেন অফসাইডের সিদ্ধান্ত। ৩৪ মিনিটে আবার মার্তিনেজ বল জালে পাঠান। কিন্তু আবারও অফসাইডের বাঁশি!




প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনা একটি গোল করেছে, তিনটি গোল বাতিল হয়েছে। আর্জেন্টিনার গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজকে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আসা বল মাত্র একবারই ধরতে হয়েছে। দলটি ৫৫ শতাংশ বলের দখল রেখেছে। এরপরও বলা যাবে না, তারা সৌদি আরবকে উড়িয়ে দিয়েছে। মেসি ছিলেন অনেকটাই ম্লান, দেখা যায়নি উইংয়ে দি মারিয়ার ভোঁ–দৌড়!

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে মিনিট দুয়েক আর্জেন্টিনা ছিল নিজেদের অর্ধে বন্দি। এটার সুযোগ নিয়ে মেসিদের চরম ক্ষতিটা করে ফেলে সৌদি আরব। ৫ মিনিটের ছোট্ট এক ঝড়ে আর্জেন্টিনাকে এলোমেলো করে দেয় তারা। ৪৮ মিনিটে সৌদি আরবকে সমতায় ফেরান সালেহ আল–শেহরি। মাঝমাঠ থেকে উড়ে আসা বলে দুর্দান্ত প্রথম ছোঁয়ায় সেটি নিয়ন্ত্রণে নেন তিনি। এরপর রোমেরোর পায়ের নিচ দিয়ে বল পাঠান জালে।




পুরো ফুটবল বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে ৫৩ মিনিটে সৌদি আরবের জয়সূচক গোলটি করেন সালেম আল দাওসারি। মাঝমাঠ থেকে উড়ে আসা বলে কিক নিয়েছিলেন সৌদি আরবের একজন। সেটি হেডে ফিরিয়ে দেন আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডার ক্রিস্তিয়ান রোমেরো। বল গিয়ে পরে আল-শেহরির পায়ে। বক্সের মধ্যে আর্জেন্টিনার দুজন ডিফেন্ডারের সামনে তিনি যেন ছোট্ট একটা নাচ দিলেন, এরপর অসাধারণ এক শটে মার্তিনেজকে ফাঁকি দিয়ে বল পাঠালেন জালে।

৫ মিনিটের এই ঝড়ে এলোমেলো হয়ে যাওয়া আর্জেন্টিনার ওপর কিছুক্ষণ ছড়ি ঘোরান আল–শেহরি, আল দাওসারিরা। মিনেট দশেক পর যেন হুঁশ ফেরে মেসি–দি মারিয়াদের। এবার তারা গতি আর ছন্দময় ফুটবলের ঢেউ নিয়ে আছড়ে পড়ে সৌদি আরবের রক্ষণে। ৭১ মিনিটে মেসির পাস গিয়ে পড়ে বক্সে থাকা দি মারিয়ার পায়ে। কিন্তু তিনি বল তুলে দেন সৌদি আরবের গোলকিপার মোগাম্মদ আলওয়াইসের হাতে। ৮৩ মিনিটে মেসির হেড রুখে দেন তিনি। ৯০ মিনিটে বল বিপদমুক্ত করতে গিয়ে আলওয়াইস সামনে চলে যান। এ সময় বল চলে যাচ্ছিল জালে, কিন্তু অসাধারণ এক হেডে তা আটকে দেন সৌদি আরবের ডিফেন্ডার।




যোগ করা সময়েও বেশি কয়েকবার গোলের সুযোগ আসে আর্জেন্টিনার সামনে। কিন্তু সৌদি আরবের গোলকিপার আলওয়াইস কখনো ‘স্প্যানিশ ম্যাটাডোর’, কখনো আবার জার্মানির সুইপার গোলকিপার ‘ম্যানুয়েল নয়্যার’ হয়ে আবির্ভূত হয়ে রুখে দেন মেসিদের। ফল টানা ৩৬ ম্যাচের অপরাজেয় যাত্রা থেমে গেছে আর্জেন্টিনার। এর আগে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বশেষ আর্জেন্টিনা হেরেছিল ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর প্যারাগুয়ের বিপক্ষে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে।




Comments

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ